‘এক মুঠো রোদ, আকাশভরা তারা। ভিজে মাটিতে জলের নকশা করা।’—দুই বাংলার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী অর্ণবের এই গেয়ে চলেছেন ৬ বছর বয়সী ঋতুরাজ, পাশেই তার সঙ্গে গিটার বাজাচ্ছেন পিতা শুভাশীষ ভৌমিক। সম্প্রীতি দেশের বেসরকারি একটি মোবাইল অপারেটরের বিজ্ঞাপনের এই দৃশ্যের সঙ্গে অনেকেই হয়তো এরইমধ্যে পরিচিত হয়ে গিয়েছেন। ছোট ঋততুরাজ এবং তার পিতা শুভাশীষকে হয়তো অনেকেই এখন চিনে গেছেন। চিনবেন না-ই বা কেন, পিতা-পুত্রের গানের সঙ্গে অনেকেই যে পরিচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক কিংবা ইউটিউব দুটি মাধ্যমেই যেন নিজেদের গানে দর্শক মাতাচ্ছেন ৬ বছর বয়সী ঋতুরাজ। পুরো নাম ঋতুরাজ ভৌমিক হূদ্য, অন্যদিকে তার পিতা শুভাশীষ ভৌমিক শুভ।
বাপকা-বেটা নামক ইউটিউবে একটি চ্যানেলও রয়েছে তাদের। যেখানে জনপ্রিয় গানগুলো কাভার করে এরইমধ্যে বেশ চমকে দিয়েছেন ৬ বছর বয়সী হূদ্য। সম্প্রীতি বাপকা বেটার পর্দার আড়ালের গল্প জানতে কথা হয় শুভাশীষ ভৌমিকের সঙ্গে। নিজের খুব ছোটবেলা থেকেই মায়ের হাত ধরে গানের জগতে আসেন শুভাশীষ। সেই থেকেই রয়েছে গানের প্রতি শুভাশীষের রয়েছে আলাদা ঝোঁক। পড়ালেখার তাগিদে গান থেকে লম্বা সময়ের বিশ্রাম নিলেও সন্তান হূদ্যের জন্মের পর থেকেই তাকে সামনে রেখে গিটার বাজানোতেই খুঁজে পেতেন অন্যরকম আনন্দ। পিতার গিটারের সঙ্গে গান শুনেও বেশ আনন্দ পেতেন ছোট্ট হূদ্য। এতেই নয়, চেষ্টা করতেন গাইতেও।
‘ঋতুরাজের তখন ৫ বছর, আস্তে আস্তে কথা বলা শিখছে। তখনই লক্ষ্য করলাম গানের প্রতি তারও ভালোবাসা জন্মাচ্ছে। খুব অল্পতেই দু-তিনটি গানও মুখস্ত করে ফেললো।’—এভাবেই ছেলের গানের জগতে প্রবেশের গল্প বলছিলেন শুভাশীষ। একদিন শুভাশীষের সঙ্গে গাইতে বসে গেলেন ঋতুরাজও। মুহূর্তটিকে আনন্দের সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি করে ভিডিওটি নিজের ফেসবুকে আপলোড করেন শুভাশীষ। ব্যস! গল্পটা এতটুকুই। পরেরটা হয়তো অনেকেরই জানা। মুহূর্তেই পিতা-পুত্রের ভিডিও দখল করে নেয় হাজারও মানুষের ফেসবুক প্রোফাইল। খুদে বার্তায় আসতে থাকে পিতা-পুত্রের জন্য শুভেচ্ছা। অবশ্য এত ভালোবাসা পাবেন তা কল্পনায় ছিল না শুভাশীষের।
‘চিন্তাটা এলো তখনই, ভাবলাম আমাদের পিতা-পুত্রের গানের এই অসাধারণ স্মৃতিগুলোকে যদি আর্কাইভ হিসেবে রাখা যায় তাহলে কেমন হয়।’—এই চিন্তাতেই চলতি বছরের জুলাই মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আইডি এবং ইউটিউবে খুললেন চ্যানেল। যেহেতু গল্পটা বাবা-ছেলেরই, তাই নাম দিলেন ‘বাপকা বেটা’। এই নামেই এখন তাদের পরিচয়। ঋতুরাজ-শুভাশীষ ছাপিয়ে মানুষ চিনছেন বাপকা বেটা নামেই। পূর্বে তাদের চ্যানেলে জনপ্রিয় বাংলা গানকে কাভার করার ভিডিও থাকলেও বর্তমানে বাপকা বেটা হাজির হচ্ছেন ভিন্নভাবে। নিয়ে এসেছেন নিজেদের প্রথম মৌলিক ছড়া গান, যেটি এই ডিসেম্বরেই তাদের চ্যানেলে প্রকাশ পাবে জানিয়ে শুভাশিষ বলেন, ‘আমাদের দেশের শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত ছড়া গানের অভাব রয়েছে। বিষয়টিকে পূর্ণতা দিতেই ছড়া গান নিয়ে আমরা বাপ-বেটা হাজির হচ্ছি।’
ছোট্ট ঋতুরাজ ভৌমিক হূদ্যের বয়স সবে মাত্র ৬ বছর। এই অল্প বয়সেই নিজের গান শুনিয়ে জয় করছেন দর্শকদের মন। অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত ঋতুরাজ শুধু গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, পড়ালেখার পাশাপাশি ভালো ছবি আঁকতেও পারে। রঙ-তুলিও যেন ছাড় পাচ্ছে না ছোট্ট হূদ্যের হাত থেকে। এরইমধ্যে ঋতুরাজ স্কুলে পেয়েছে গায়কের খেতাব। সঙ্গে নিজেই পরিচালনা করছে বিদ্যালয়ের প্রাত্যহিক জাতীয় সংগীত। বড় হয়ে তবে কী গায়কই হতে চায় ঋতুরাজ? বাবার দেখাদেখি ইঞ্জিনিয়ার এবং দাদুর দেখাদেখি সেনা কর্মকর্তা হওয়ায় প্রবল আগ্রহ তার। তবে ঋতুরাজ জানিয়ে দিলো সে দুটি পেশাতেই নিজেকে গড়ে তুলবে, সঙ্গে যুক্ত থাকবে গানে।
অন্যদিকে ঋতুরাজের পিতা শুভাশীষ ভৌমিক শুভ। একজন প্রফেশনাল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করে বর্তমান কাজ করছেন দেশের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। গানের প্রতি শুভাশীষের আগ্রহটা পরিবারের থেকেই। ছোট থেকেই যুক্ত আছেন পার্টটাইম গায়ক হিসেবে।
বাপকা বেটার এই দুই পরিচিত মুখ ছাড়াও এর পেছনে রয়েছে আরেকজনের অংশগ্রহণ। তিনি মৌসুমী সাহা জুঁই, ঋতুরাজের মা ও শুভাশীষের স্ত্রী। পেশায় একজন গৃহিনী হলেও রয়েছে একজন অনলাইন ব্যবসায়ীর পরিচয়ও। বাপকা বেটার প্রতিটি ভিডিওর ক্যামেরার পেছনের মানুষ তিনি। এছাড়াও স্বামী সন্তানকে দিয়ে যাচ্ছেন পূর্ণ সমর্থন। বাপ-বেটার সামনের লক্ষ্য কী? সকলকে উপহার দিয়ে যেতে চান নিজেদের মৌলিক গান। সঙ্গে কাজ করে যেতে চান ছড়া গান নিয়ে। এই বাবা-ছেলের দু’জনের সবসময় একই রকমের টি-শার্ট বা গেঞ্জি পড়ার বিষয়টি হয়তো অনেকেই খেয়াল করেছেন। বাবা ছেলের মিলটা যে তাদের পোশাকেও, সেটাই হয়তো তার ইঙ্গিত। শুভাশীষ আরো যোগ করেন, ‘আমাদের বাবা ছেলের আনন্দের মুহূর্তটাকে ধরে রাখতেই এই উদ্যোগ। সন্তানদের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে তাদের চাপ প্রয়োগ না করে সৃজনশীল কাজগুলোকে তুলে ধরতে চেষ্টা করুন। তাছাড়া সকলের উদ্দেশ্যে বলতে চাই সবরকম ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানদের যথেষ্ট সময় দেওয়া উচিত, যা তাদের সুস্থ বিকাশে ভূমিকা রাখবে।’ শুরুর মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই ঋতুরাজ এবং শুভাশীষ যেন নিজেদের অর্জনটা খুঁজে পাচ্ছেন সকলের ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণাতেই।
Source: https://www.ittefaq.com.bd